চিন্তা ও ধান্ধা
আজকাল আমাদের সমাজে এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে কোন না কোনধান্ধার পেছনে ঘুরছে না? উঠতি বয়সের তরুণ থেকে শুরুকরে বয়সী কর্মজীবি মানুষ, সবাইএকটার পর একটা ধান্ধায় সমস্ত জীবনপার করে দিচ্ছে। নিজের ধান্ধা ছাড়া অন্য কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় কারো নেই। সবার মুখে একই কথা “ভাই আমি খুবই ব্যস্ত, আমার কোন সময় নেই।”
আসুন আমরা দেখি কোন ধান্ধার পেছনে আমরা পাগলের মত ছুটে চলেছি আর কি নিয়েই বা সমাজের তরুণ বৃদ্ধ সবাই এত ব্যস্ত। এখনকার দিনে তরুণদের একমাত্র ধান্ধা হচ্ছে যত বেশী পারা যায় ফুর্তি করা, আনন্দে থাকা, জীবনের স্বাদ উপভোগ করা। কলেজ- ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেদের মধ্যে এখন একই চিন্তা কিভাবে অ্যাফেয়ার করা যায়। নিত্যদিনের আলোচনার কিছু কমন বিষয় হল মেয়ে, বন্ধু, আড্ডা, ক্যারিয়ার ইত্যাদি। হলিউড-বলিউড সংস্কৃতির আগ্রাসন তাদের চিন্তার জগতটাকে এতটাই দখলে নিয়েছে যে এগুলো ছাড়া অন্য কিছু তারা ভাবতেই পারেনা। বয়সের সাথে সাথে আমাদের ধান্ধাও পাল্টায়। শিক্ষা জীবনের শেষে যুবকদের মাথায় ঢোকে ক্যারিয়ারের ধান্ধা। এখন তার মাথায় একটাই চিন্তা কিভাবে, কাকে ধরে, ঘুষ কিংবা তোষামোদ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। সহসাই সে বুঝতে পারে চাকুরীর বাজারে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা অনেক, তাই তাকে ‘জ্যাক’ ধরতে হবে। শুরু হয় ‘মামা’ খোঁজার ধান্ধা। বয়স যখন পঁয়ত্রিশ কোঠা পেরোয় আর সংসার জীবন শুরু হয় তখন তার ধান্ধাও পাল্টে যায়। এখন তার ধান্ধা হলো কিভাবে ধন সম্পদ আরো বাড়ানো। এজন্য বৈধ-অবৈধ কোন বাছবিচার নেই, যেকোনভাবে সম্পদ অর্জনই এখন লক্ষ্য। এখন টাকাই টার একমাত্র মাথাব্যাথা, চুড়ান্ত ধান্ধা। তার সমস্ত চিন্তা, কথা ও কাজের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য - টাকা উপার্জন। আর্থিক লাভক্ষতিই এখন তার মাপকাঠি। লাভ হলে সে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে বা কথা বলে আর লাভের সম্ভাবনা না থাকলে তা করে না। যত টাকা আর সম্পদ তত ‘সম্মান, ‘গুরুত্ব’, ‘স্ট্যাটাস’, আর ‘নিরাপত্তা’ – এটাই আজকের সমাজের প্রচলিত ধারণা। এখন একটা জিনিস খেয়াল করুন আমরা যারা এই ধান্ধা কালচারের মধ্যে ডুবে আছি তারা কিন্তু খুব বেশী চিন্তা-ভাবনা করে এটা গ্রহন করিনি। জীবনের সফলতার এই ধারণাকে আমরা অন্ধভাবে গ্রহণ করেছি, কিন্তু সফলতার সঠিক সংজ্ঞাই আমরা বুঝতে পারিনি। তাই তো আমরা দেখি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট কিংবা এপ্লাস না পেলে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, প্রেমে ব্যর্থ হলেও তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, উত্থান-পতনের ক্যারিয়ারে একটু হোঁচট খেলেই হতাশ তরুন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
এজন্যই আমরা দেখি বর্তমান যুগে জীবনযাপন এত সহজ, আরামদায়ক হওয়া সত্ত্বেও আত্মহত্যার হার পুর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। জীবন ধরে শুধুমাত্র বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় সুখের জন্য একটার পর একটা ধান্ধার পেছনে ছুটে চলবে, একজন বিবেকবান মানুষের কাছে এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে কি? আমরা দেখি মানুষের চেয়ে অনেক বড় এবং শক্তিশালী প্রাণীদেরকেও মানুষ পোষ মানায় এবং নিজের কাজে ব্যবহার করে। ফলে মানুষ পৃথিবীতে শাসন করে, প্রাণীরা নয়। মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ থাকার কারণেই মানুষ এটা করতে পারে আর তা হলো তার নিজ ও তার চারপাশের জগতকে নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা। এ ক্ষমতাটা অবশ্যই ব্যবহারের দাবি রাখে। মানুষকে অবশ্যই এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে হবে এবং তার চারপাশের জগত, তার নিজের জীবন এবং অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করতে হবে। শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া ভোগ বিলাস আর সন্তান জন্ম দিয়ে পশুর মত সমস্ত জীবন কাটিয়ে দেয়া তো কখনোই মানুষের কাজ হতে পারেনা। একজন মানুষকে অবশ্যই জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। সে কিভাবে কোথা থেকে এ পৃথিবীতে এসেছে? তার জীবনের উদ্দেশ্য কি? এই জীবনের পরে কি ঘটবে? আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনের একটি গুরুত্তপুর্ন সময় অতিবাহিত করে ফেলেছি কিন্তু আমরা এখনো এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর সঠিক জ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নই। যার ফলে আমরা কখনো পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করাকেই জীবনের গন্তব্য মনে করি, কখনোবা অর্থ উপার্জনকেই জীবনের উদ্দেশ্য মনে করি। তাইতো ব্যর্থ হলেই বেছে নিই আত্মহননের পথ। এসকল কাজে-ধান্ধার মধ্যে যে আমরা ডুবে আছি, এগুলো কতটুকু যুক্তিযুক্ত বা আমরা যে অন্ধের মত এসবের পেছনে ছুটছি তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তা নিয়ে আমরা কখনো চিন্তা করেছি কী?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন